সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকায় মৃত মানুষের নাম দেখিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে বিতরণ করা গরু, গো-খাদ্য ও ঘর নির্মাণের সরঞ্জাম আরেক জনের মাধ্যমে তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর বিরুদ্ধে।
সমতল ভূমির অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে এসব বিতরণ করা হয়।
অভিযোগ, সুবিধাভোগীর তালিকায় ২০১৫ সালে মৃত নির্মলা সাংমার নাম অন্তর্ভূক্ত থাকায় তাকে উপস্থিত করতে না পেরে আলভার্ট নামে এক ব্যক্তির নামে উত্তোলনের পর হোটেলে খাইয়ে মাত্র দশ হাজার টাকার বিনিময়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে ওইসব নিয়ে নেন হযরত আলী। এসব উল্লেখ করে বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের অধীনে উপজেলার সমতল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ৫০ জনের মাঝে একটি করে গরু, ১৫০ কেজি করে গো-খাদ্য ও গোয়ালঘর নির্মাণের জন্য ৫টি খুঁটি, ৫টি ঢেউটিন এবং ১৬০টি ইট বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
১নং পোড়াগাঁও ইউনিয়ন থেকে তালিকা আহবান করা হলে গত ৭ আগস্ট তালিকা প্রেরণ করেন ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন।
তালিকায় উপকারভোগীদের মাঝে আন্ধারুপাড়া গ্রামের ২০১৫ সালে মৃত নির্মলা সাংমার নাম অন্তর্ভূক্ত করেন তিনি। ৩০ আগস্ট এসব বিতরণের তারিখ ধার্য করে উপজেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়। তবে এর আগেই জামাল উদ্দিন দেশের বাইরে চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য হযরত আলী।
বিতরণের আগের দিন পর্যন্ত মৃত নির্মলার জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হযরত আলী মোবাইল ফোনে চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করেন। পরামর্শ অনুযায়ী নির্মলার নাম পাল্টে একই গ্রামের আলভার্টকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
এদিকে ৩০ আগস্ট সকালে বাড়ি থেকে জনৈক হাবেজ উদ্দিনকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে নিজের মোটরসাইকেলে করে আলভার্টকে নালিতাবাড়ী নিয়ে আসেন হযরত আলী।
পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে আলভার্ট তার নামে থাকা গরুসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উত্তোলন করেন।
পরে হোটেলে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে আলভার্ট এর হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে গরুসহ প্রায় অর্ধলাখ টাকার মালামাল নিয়ে নেন হযরত আলী। শুধু তাই নয়, হযরত আলী নিজের মোটরসাইকেলে করে পুনরায় আলভার্টকে তার বাড়ি পৌঁছেও দেন। এর আগে আলভার্টের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নেন হযরত আলী।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক টাইমলাইনে আলভার্টের গরু নেওয়ার ছবি প্রকাশ করা হলে এলাকায় বিষয়টি জানাজানি হয়। একপর্যায়ে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে বুধবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন আলভার্ট।
আলভার্ট জানান, ২৯আগস্ট রাতে তাকে ডেকে বাড়ি থেকে বের করে চা পান করিয়ে বিষয়টি জানায় হাবেজ উদ্দিন। পরদিন কথামতো হাবেজ উদ্দিন তাকে ডেকে এনে নিজে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তাকে মাঝখানে বসানো হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হযরত আলী মোটরসাইকেল চালিয়ে শহরে আনেন। গরু উত্তোলনের পর হোটেলে খাবার খাওয়ানোর পর দশ হাজার টাকা হাতে দেওয়া হয় আলভার্টের। পরে ওই গরু এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে তাকে পুনরায় বাড়ি পৌঁছে দেন হযরত আলী।
এলাকাবাসী জানান, ২০১৫ সালে নির্মলা মারা যাওয়ার পরও মাত্র একমাস আগে তার নাম সুবিধাভোগীর তালিকাভুক্তির বিষয়টি রহস্যজনক। চেয়ারম্যান সাহেব শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আলভার্টের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে হযরত আলীর বিচার দাবী করেছেন। আলভার্টের শ্যালিকা রফলা চাম্বুগং বলেন, আমাদের নাম ভাঙিয়ে হযরত আলী এই কাজটা করছে। আমরা ইউএনও স্যারের পোষ্টে ছবি দেখে বিষয়টা জানতে পারি। হযরত আলীর এই প্রতারণার বিচার চাই আমরা। একই এলাকার নছির বলেন, চেয়ারম্যান ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছেন। নয়তো সাত আট বছর আগে মারা যাওয়া নির্মলার নাম তালিকায় আসতো না। জামাল চেয়ারম্যান নিজেও এই কাজটার সাথে জড়িত।
এ বিষয়ে মতামত জানতে এলাকায় গিয়ে হযরত আলীকে পাওয়া যায়নি। তবে মুঠোফোনে তিনি জানান, নির্মলার মৃত্যুর বিষয়টি আমরা জানতাম না। জানার পরে আলভার্টের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি নিজে তাকে নিয়ে গেছি গরু তুলতে। এরপর আমি আর কিছু জানিনা। গরু কিনে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এই বিষয়টা পুরোটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার সম্মান নষ্ট করার জন্য কেউ এই নাটকটা সাজিয়েছে। গরু কোথায় আছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গরু আমি নিজেও খোঁজ লাগাইছি। দেখি কই আছে। এদিকে দেশের বাইরে থাকায় ম্যাসেঞ্জারে চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করে মতামত জানতে চাওয়া হলে তাকে অনলাইনে পাওয়া যায়নি।
এদিকে এ বিষয়ে নালিতাবাড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোকসেদুর রহমান লেবু বলেন, আমি ঢাকায় আছি। এ বিষয়ে তেমন কোন কিছু শুনিনি। নালিতাবাড়িতে ফিরে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো। উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ ফয়জুর রহমান লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, চেয়ারম্যান সাহেব দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
এ বিষয়ে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা কর্মকর্তার সাথে কথা বলছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হবে।